আমি গবেষণার সাথে জড়িত আছি ২০০৭ সাল থেকে। ডেভেলপমেন্ট বা উন্নয়ন খাতের বিভিন্ন শাখায় বিভিন্ন দেশী এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে কাজ করেছি। যদিও তৈরি পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে বেশ কয়েকবার, তবে সরাসরি তৈরি পোশাক কারখানা নিয়ে প্রথম কাজ করি ২০১৫ সালে। তৎকালীন C&A Foundation, বর্তমান Laudes Foundation দ্বারা অর্থায়নকৃত একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নেয় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অন্ট্রেপ্রেনরশিপ ডেভেলপমেন্ট (সিইডি)। পাইলট প্রকল্পটির নাম ছিল Participatory Factory Mapping Research – সংক্ষেপে PFMR। এই পাইলট প্রকল্পের জন্য প্রথম তৈরি পোশাক কারখানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করি। পাইলটটি করা হয়েছিলো ঢাকার মিরপুরে এবং গাজীপুরের কালিয়াকৈরে।

এ পাইলটের প্রেক্ষাপটে ২০১৭ সালে লাউডেস ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে ৪ বছরের জন্য সিইডি সকল রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানাকে ডিজিটাল ম্যাপিং-এর আওতায় আনতে একটি প্রকল্প হাতে নেয়, যা ম্যাপড ইন বাংলাদেশ বা Mapped in Bangladesh বা এমআইবি (MiB) নামে পরিচিত। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের শেষভাগে নেদারল্যান্ডস সরকারের অর্থায়নও যুক্ত হয় এ প্রকল্পের সাথে।

প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য দেশের সকল রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা চিহ্নিত করে পোশাক খাতের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার স্বার্থে কারখানার তথ্যউপাত্ত একটি ডিজিটাল ম্যাপের মাধ্যমে তুলে ধরা (গুগল ম্যাপের অনুরূপ)। ২০১৮ সালের জানুয়ারী মাসে আমি এই প্রকল্পে নিয়োগ পাই এবং সেই সময় থেকেই আরো কাছ থেকে দেশের তৈরি পোশাক খাতকে দেখার সৌভাগ্য হয়। অর্জন করি নানান রকমের অভিজ্ঞতা এবং জানতে পারি বিভিন্ন অজানা তথ্য।

সর্বপ্রথম সমস্যার মুখোমুখি হই ফ্যাক্টরি বা কারখানার সংজ্ঞা নিয়ে। কাকে ফ্যাক্টরি বা কারখানা বলা যায়, সেটা নির্ণয় করাই ছিলো প্রথম চ্যালেঞ্জ। বাস্তবে যেমন একটা ফ্যাক্টরি বা কারখানা একটি সুসংগঠিত ভবনে অবস্থিত হতে পারে, আবার পাকা দেয়াল ও মেঝে সহ উপরে টিনের চালা দেওয়া সেমি-পাকা ভবনেও থাকতে পারে। আবার একটি ফ্যাক্টরি একটিমাত্র সেলাই বা সিউইং মেশিন নিয়েও হতে পারে, আবার ৫০০ সিউইং মেশিন নিয়েও হতে পারে। তাই এমআইবি প্রকল্পের পরিপ্রেক্ষিতে কাকে ফ্যাক্টরি বা কারখানা বলা যায়, তা একটি বিশাল গোলকধাঁধা তৈরি করলো। পরবর্তীতে এমআইবি প্রকল্পের আওতায় কী ধরণের কারখানা বা ফ্যাক্টরি আসতে পারে, সেই নির্দেশনার জন্য পোশাক খাত বিশেষজ্ঞদের মতামত ও গবেষণার উপর ভিত্তি করে কারখানার একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা (Definition) নির্ধারণ করা হয়।

আমরা তৈরি পোশাক খাত বলতে যা বুঝি, বাস্তবে তৈরি পোশাক খাত আরো বৃহৎ, আরো ব্যাপক বা বিস্তৃত । এ খাতের ভিতর যে কী আছে তা বিস্ময়কর এবং কল্পনাতীত। উদাহরণস্বরূপ, মিরপুর ১৪-তে অবস্থিত কারখানার কথাই বলি। এই এলাকায় কয়েকশত ছোট ছোট পোশাক কারখানা আছে। কিন্তু এরা টেইলরিং শপ বা দর্জির দোকান না। এরা ব্যাচে বা লটে পোশাক তৈরি করেন। এরা আবার মূল পোশাক খাতের আওতার মধ্যেও পড়েন না। এরা একটি পাকা বা কাঁচা ঘরে একটি বা দুটি মেশিন নিয়ে, মাত্র ২/৩ জন কর্মচারী নিয়ে পোশাক তৈরি করেন। এখানে কিছু কিছু কারখানা আবার নামাজে ব্যবহারকৃত টুপিও তৈরি করে থাকেন। অনেক কারখানা আবার ঝুট কাপড় (কারখানায় পোশাক তৈরির পর ফেলে দেয়া টুকরো কাপড়) সংগ্রহ করে পোশাক তৈরি করেন।

অন্যদিকে কেরাণীগঞ্জে, নদীর ওপাড়ে আছে অনেক ছোট ছোট কারখানা। এসব কারখানায় তৈরি হয় শার্ট, প্যান্ট, গেঞ্জি, ডেনিম প্যান্ট, ও হোসিয়ারি পণ্য। বড় বড় ভবনে ছোট ছোট (৬ ফিট x ৮ ফিট) দোকানের আকারে এসব কারখানা পরিচালিত হয়। এদেরও একটি বা দুটির বেশি সিউইং মেশিন নেই। নেই কোন প্রোডাকশন লাইন। স্থানীয় বাজার থেকে কাপড় কিনে মালিকরা এসব কারখানায় পোশাক তৈরি করে থাকেন। সাপ্লাই দেন নিকটবর্তী পাইকারি মার্কেটে। এই পাইকারি মার্কেট থেকে এ সব পণ্য চলে যায় দেশের নানান যায়গায় – বিভিন্ন জেলা, উপজেলা, বা গ্রামের কোন বাজারে। অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এ সকল পণ্য আবার বিভিন্ন দেশে রপ্তানিও হয়ে থাকে। নিজস্ব চ্যানেলের মাধ্যমে এসব পণ্য চলে যায়  নিকটবর্তী ভারত অথবা অন্য কোন দেশে।

শুধু মিরপুর ও কেরাণীগঞ্জে অবস্থিত এ সকল ছোট ছোট কারখানার বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রচেষ্টা সাধারণত কারো নজরে পড়ে না। এ কারণে এরা (এবং সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এমন সকল কারখানা) সকল পরিকল্পনা এবং সকলের নজর থেকে থাকে অন্তরালে বা  উপেক্ষিত।

আবার কিছু বড় কারখানা আছে, যারা বিভিন্ন মোড বা কার্যপদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। এখানে যে সকল কারখানার কথা বলছি, তারা প্রকৃতপক্ষেই কারখানা বা ফ্যাক্টরি। এদের অনেক মেশিন আছে, আছে অনেক সেকশন, আছে প্রোডাকশন এসেম্বলি লাইন। এসব কারখানাগুলো সাধারণত –

  • শুধু রপ্তানি বাজারের জন্য উৎপাদন করে;
  • শুধু সাব-কন্ট্রাক্টে বা মূল চুক্তির অধীনে অন্য চুক্তিতে কাজ করে;
  • শুধু স্থানীয় বাজারের জন্য উৎপাদন করে;
  • রপ্তানি বাজারের জন্য উৎপাদন করেন, সাব-কন্ট্রাক্টে; এবং স্থানীয় বাজারের জন্য পণ্য উৎপাদন করে;
  • রপ্তানি বাজারের জন্য এবং সাব-কন্ট্রাক্টে পণ্য উৎপাদন করে;
  • রপ্তানি বাজারের জন্য এবং স্থানীয় বাজারের জন্য পণ্য উৎপাদন করে; অথবা
  • সাব-কন্ট্রাক্টে এবং স্থানীয় বাজারের জন্য পণ্য উৎপাদন করে।

এই সাব-কন্ট্রাক্ট আবার স্থানীয় বাজার অথবা রপ্তানি বাজারের জন্য হতে পারে। আবার, রপ্তানি বাজারে সরাসরি পাঠানো হয় অথবা অপ্রথাগত চ্যানেলের (informal channel) মাধ্যমে বিদেশে পণ্য রপ্তানি করা হয়। অপ্রথাগত চ্যানেলের মাধ্যম হিসাবে প্রচলিত আছে কুরিয়ার সার্ভিস, লাগেজে করে পাঠানো, ইত্যাদি।

কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে এক কারখানা পরিদর্শনকালে জানতে পারলাম এক অজানা তথ্য। মূল মালিকের সাথেই কথা হয়েছিলো। করোনা মহামারীর আগে তাঁর মাঝারি আকারের একটি কারখানা ছিলো, যেখানে ২০/২৫ জন কর্মচারী নিয়ে তিনি তাঁর কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। করোনাকালে তাঁকে ছাটাই করতে হয় বেশ কিছু কর্মচারীকে। তবে কারখানার কার্যক্রম থামাননি। একটি ছোট লম্বাটে ঘরে দুটি মেশিন এবং পাঁচজন শ্রমিক নিয়ে সেই সময় পরিচালনা করছিলেন তাঁর কারখানা। তিনি তৈরি করেন নামাজের টুপি। সেই টুপি কুরিয়ার অথবা লাগেজের মাধ্যমে রপ্তানি হয় সৌদি আরবে। এক একটি টুপি তিনি বিক্রি করেন ৬,০০০ টাকায়।

এই তৈরি পোশাক খাতকে ঘিরে গড়ে উঠেছে আরো অনেক কারখানা, বেড়েছে কর্মসংস্থান। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় এমব্রয়ডারি, প্রিন্টিং, এবং ওয়াশিং কারখানার কথা। এসব কারখানা স্থাপন করতে খুব একটা বেশী বিনিয়োগ করতে হয় না। একটি বা দুটি মেশিন নিয়েই শুরু করা যায় এসব কারখানা। আবার কাজেরও অভাব হয় না। ছোট-বড় সব কারখানাই এ সকল ছোট এমব্রয়ডারি, প্রিন্টিং, এবং ওয়াশিং কারখানায় নিয়মিত কাজ দেন। এসকল কারখানা যে শুধু ছোট হয় তা নয়। অনেক বড় বড় এমব্রয়ডারি, প্রিন্টিং, এবং ওয়াশিং কারখানাও আছে। এমনও ওয়াশিং কারখানা আছে যেখানে ১০,০০০ শ্রমিক কাজ করেন।

মাঠ পর্যায়ে তথ্য আনতে গিয়ে অনেক অপ্রত্যাশিত বা অনাকাঙ্ক্ষিত জায়গায় মিলেছে ফ্যাক্টরি বা কারখানা। একবার নারায়ণগঞ্জের এক এলাকায় গেলাম আমাদের ফিল্ড টিমের সাথে। আশেপাশে খোঁজ নিয়ে জানলাম যে একটি রাস্তায় একটি ফ্যাক্টরি বা কারখানা আছে। রোডের এ মাথা থেকে ও মাথা খুঁজেও কারখানাটির অবস্থান বের করতে পারলাম না। আশেপাশে আবার জিজ্ঞাসা করতেই একজন একটি ভবন দেখিয়ে দিল। ভবনের সামনে এসে দেখি সেটি একটি প্রাইভেট হাসপাতাল। কিন্ত কারখানা কোথায়? একটু বাদেই দেখতে পেলাম ভবনের পেছন দিক থেকে ধোঁয়া উড়ছে। তার মানে কাঙ্ক্ষিত কারখানাটি এই ভবনেই অবস্থিত। সিঁড়ি বেয়ে  তিনতলায় গিয়ে পেলাম সেই কাঙ্ক্ষিত কারখানা। অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় এই যে, একটি প্রাইভেট হাসপাতালের উপর অনায়াসে তারা পোশাক তৈরি করে চলেছেন। আরো আশ্চর্যের বিষয় ছিলো যে কারখানাটি অসম্ভব পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম, এবং গোছানো। এর বাইরেও আরো অনেক অনেক অজানা তথ্য আছে। তবে যে সকল তথ্য এই লেখায় বর্ণনা করলাম, তা কখনই জানতে পারতাম না যদি না Mapped in Bangladesh (MiB) প্রজেক্টের সাথে যুক্ত হতাম।

পরিশেষে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ম্যাপড ইন বাংলাদেশ প্রকল্পের ওয়েবসাইটে (www.mappedinbangladesh.org) শুধুমাত্র ৮০% রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানাগুলো যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের রপ্তানি নীতি ২০১৫-২০১৮ অনুযায়ী শুধু ঐ সকল শিল্পই রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবে বিবেচিত, যারা তাদের মোট উৎপাদিত পণ্যের শতকরা ৮০% ভাগ রপ্তানি করে থাকে। এই কারখানাগুলোকে একটি নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসে পোশাক খাতের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে ম্যাপড ইন বাংলাদেশ প্রকল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এই ৮০% রপ্তানির বাইরেও অনেক পোশাক কারখানা থেকে যাচ্ছে, যেসব কারখানা পোশাক খাতের নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ার অংশ হবার দাবি রাখে। নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে যাওয়া কারখানাগুলোর কিছু আংশিক চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি এ লেখায়। তবে এ ধরণের কারখানাগুলোর সামগ্রিক চিত্র তুলে আনতে বিস্তৃত তথ্যভাণ্ডার ও আরো বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন।

 

ফাহিম সোবহান চৌধুরী

ঊর্ধ্বতন গবেষণা সহযোগী, সেন্টার ফর অন্ট্রেপ্রেনরশিপ ডেভেলপমেন্ট (সিইডি), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়